লিভার জণ্ডিস কি ? এর কারন ও প্রতিকার সম্পর্কে জেনে নিন
গ্রামে অনেকের কাছে শুনা যায়, অমুক কবিরাজ জন্ডিস এর তাবিজ দেয়। আবার কেউ হাত ধুয়ে দিলে, জন্ডিস সেরে যায়। কেউবা কলা পড়াসহ ঝাড়ফুক দিলেই নাকি লিভার জণ্ডিস চিরতরে বিদায় নেয়। এসব নিয়েই বিশদ আলোচনা।
জণ্ডিস কি ?
সাধারনভাবে জন্ডিস মানে অনেকেই একটি বিশেষ রোগ মনে করে থাকেন। প্রকৃতপক্ষে জণ্ডিস নিজে কোনো রোগ নয়। অন্য কিছু রোগের উপসর্গ হিসাবে জণ্ডিস হয়ে থাকে। কোন কারণে রক্তে বিলিরুবিন নামক রঞ্জকের আধিক্য হলে, শরীরের চামড়া ও চোখ হলুদ হয়ে যাওয়াকে জণ্ডিস বলা হয়।
জণ্ডিসের প্যাথফিজিওলজি :
স্বাভাবিকভাবে রক্তের পুরাতন লোহিত রক্ত কণিকা, গড়ে প্রতি ১২০ দিন পর পর প্লীহা, যকৃত, অস্থিমজ্জা ইত্যাদিতে ভেঙে গেলে, হিমোগ্লোবিন বিযুক্ত হয়ে লৌহ ও বিলিভার্ডিন নামক যৌগ রক্তে বেরিয়ে আসে। এটি পরবর্তীতে বিলিরুবিনরূপে, রিসার্কুলেটেড হয়ে যকৃতে মেটাবলাইজড হয়। পরবর্তীতে starcobilin-রূপে মলের সাথে, এবং urobilin-রূপে মূত্রের সাথে শরীর থেকে বেরিয়ে যায়। কিন্তু যকৃতের প্রদাহ কিংবা পিত্তাশয়, পিত্তনালী বা অগ্ন্যাশয় গ্রন্থির বিভিন্ন সমস্যায়, বিলিরুবিনের মেটাবলিজম বাধাপ্রাপ্ত হয়।
আবার কিছু রোগ (যেমন-থেলাসেমিয়া) রয়েছে, যেগুলোতে আক্রান্ত হলে লোহিত রক্ত কণিকা অকালে, এবং অত্যধিক সংখ্যায় ভাঙতে থাকে, সেক্ষেত্রে যকৃত সুস্থ থাকলেও অতিমাত্রায়, বিলিরুবিন তৈরী হয়ে জণ্ডিস দেখা দেয়। কাজেই যে কারণেই হউক, রক্তে বিলিরুবিনের মাত্রা বেড়ে গেলে, বা এর উৎপাদন কিংবা সঞ্চালন প্রক্রিয়া ব্যাহত হলে জন্ডিস হবে, এটাই নিয়ম।
জণ্ডিস নিয়ে ট্যাব্যু বা কুসংস্কার :
জন্ডিসের চিকিৎসা নিয়ে প্রত্যন্ত পাড়াগাঁয়ে, এমনকি শহরেও অনেক ভুল ধারণা বা ট্যাব্যু প্রচলিত আছে। কিছু কবিরাজ ঝাড়ফুঁক দিয়ে জন্ডিস নামায়। কেহবা অতিহলুদে রান্না করা খাদ্য খেতে বলে, কেউ খাওয়ায় গাছের শেকড়। বরণ, তাবিজ, কবচ ইত্যাদি তো আছেই। বাংলাদেশ গরীব হলেও, চিকিৎসাসেবা বর্তমানে প্রায় সব মানুষের দোরগড়ায়। তাই জন্ডিস আক্রান্ত হলে নিকটস্থ স্বাস্থ্যকেন্দ্র, বা ডাক্তারের স্মরণাপন্ন হওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ।
জণ্ডিসের লক্ষণ :
জণ্ডিসের প্রধান লক্ষণ হল চোখ ও প্রসাবের রং হলুদ হয়ে যাওয়া। গুরুতর জণ্ডিসের ক্ষেত্রে পুরো শরীর গাঢ় হলুদবর্ণ ধারণ করতে পারে। রক্তে বিটা ক্যরোটিনের মাত্রা বেশি হলেও চামড়া হলুদ দেখাতে পারে, অনেক ক্ষেত্রে এরকম অবস্থাকে জণ্ডিস বলে ভূল করা হয়। (উল্লেখ্য, গাজর ও কুমড়ায় পর্যাপ্ত বিটা ক্যারোটিন থাকে)।
জণ্ডিসের কারনে পায়খান সাদা, বা কখনো কখনো কাদার মত হয়ে যেতে পারে, শরীর চুলকায়, যকৃতসহ পেট শক্ত হওয়া, পেটব্যথা, জ্বর, বমি, অবসাদগ্রস্ততা, শারীরিক দুর্বলতা, ক্ষুধামন্দা, ইত্যাদি উপসর্গ দেখা দিয়ে থাকে। মানব দেহে বিলুরুবিনের স্বভাবিক মাত্রা, ১.০থেকে ১.৫ mg/dl. রক্তে এই উপাদানের মাত্রা এর দ্বিগুণ হলে, বাইরে থেকে তা বোঝা যায়।
জণ্ডিসের কারণ :
যকৃতের সংক্রমণ বা হেপাটাইটিস, যকৃতের ক্যান্সার, মদ্যপান, লিভার সিরোসিস, পিত্তপাাথর, অগ্নাশয়ের টিউমার/ক্যান্সার, রক্তঘটিত সমস্যা, যেমন- হেমোলাইটিক এনিমিয়া, হেপাটোটক্সিক ড্রাগস (প্যারাসিটামল, কর্টিকোস্টেরয়েড, ফেনোথায়াজিন, পেনিসিলিন গ্রুপ ইত্যাদি) জাতীয় কোন কোন ঔষধের মাত্রাধিক সেবনের কারণে জণ্ডিস হয়ে থাকে। অনেক ক্ষেত্রে নবজাতক শিশুদের “Neonatal Jaundice” হয়ে থাকে।
জণ্ডিসের প্রকারভেদ :
চিকিৎসার সুবিধার্থে জণ্ডিস বা জন্ডিসের কারণকে ৩টি ভাগে ভাগ করা হয়। যথা-১) হেপাটোসেলুলার জণ্ডিস, ২) অবস্ট্রাকটিভ জণ্ডিস ও ৩) হেমোলাইটিক এনিমিয়া।
হেপাটোসেলুলার জণ্ডিস :
মানুষের শরীরে জণ্ডিসের কারণগুলোর মধ্যে, প্রায় দুই তৃতীয়াংশই ভাইরাল হেপাটাইটিসের জন্য হয়ে থাকে। হেপাটাইটিস এ, বি, সি, ডি এবং ই এই ৫টি ভাইরাসের সংক্রমণে যকৃতে যে প্রদাহ সৃষ্টি হয় তাকে ভাইরাল হেপাটাইটিস। হেপাটাইটিস বি ও সি-র সংক্রমণে যকৃতে দীর্ঘস্থায়ী প্রদাহ তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে, যার ফলশ্রতিতে লিভারে সিরোসিস ও ক্যান্সারের মতো জটিল রোগ দেখা দিতে পারে। লিভার সেলে সংক্রমণ ও প্রদাহ থেকে হেপাটোসেলুলার জণ্ডিস হয়।
অবস্ট্রাকটিভ জণ্ডিস :
শরীরের লোহিত রক্ত কণিকাগুলো ভেঙে, বিলিরুবিন নামক লৌহ-প্রোটিনঘটিত জটিল যৌগ তৈরি হয়। এই বিলিরুবিন যকৃতে মেটাবলাইজড হয়ে, পিত্তরসের সঙ্গে মেশে। পিত্তনালীর মাধ্যমে এই বিলিরুবিন পরিপাকতন্ত্রে যায়। সর্বশেষে এর মূল অংশ মলের সাথে এবং কিছু অংশ রক্তে শোষিত হওয়ার পর, কিডনির মাধ্যমে মূত্রের সাথে শরীর থেকে বের হয়ে যায়। পিত্তনালী, পিত্তথলি বা অগ্ন্যাশয় গ্রন্থির পাথর বা টিউমারের কারণে, বিলিরুবিনের সঞ্চালন প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হলে, রক্তে বিলিরুবিনের মাত্রা বেড়ে যায়। এর ফলে শরীরে অবসট্রাকটিভ জণ্ডিস হয়।
হেমোলাইটিক এনিমিয়া / জণ্ডিস :
কোন কারণে শরীরের রক্তকণিকা স্বাভাবিকের চেয়ে, দ্রুত ভাঙতে থাকলে বা রক্তে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা কমে গেলে জন্ডিস দেখা দেয়। এ রকম অবস্থাকে হেমোলাইটিক এনিমিয়া বলা হয়। এধরনের জন্ডিসের ক্ষেত্রে, চোখের সাদা অংশ হলুদ বর্ণ ধারণ করে। এর পাশাপাশি চোখের পাতার ভেতরের অংশ সাদা হয়ে যেতে পারে।
জণ্ডিসের পরীক্ষা :
যেসব রোগের উপসর্গ হিসাবে জণ্ডিস হয়, মূলতঃ ঐসব রোগ চিহ্নিত করার জন্যই পরীক্ষা করা হয়। এক্ষেত্রে নিচের পরীক্ষাগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যেমন- রক্তে বিলিরুবিন মাত্রাসহ অন্যান্য ‘লিভার ফাংশন টেস্ট, যথা-Alpha-1Antitrypsin, ALP, AST, ALT, GGT, PT, aPTT, Albumin, AP ইত্যাদি।
এগুলোর মাধ্যমে যকৃতের দ্বারা তৈরী কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রোটিন, ও এনজাইমের স্বাভাবিক/অস্বাভাবিক মাত্রা চিহ্নিত করে, মূল রোগ সনাক্ত করা হয়। পরে সম্ভাব্য কারণ অনুযায়ী নির্ধারিত অন্য পরীক্ষার নির্দেশ দেয়া হয়। তাছাড়া যকৃতের আল্ট্রাসনোগ্রাফি, CT স্ক্যান, MRI, লিভার বায়োপসি ইত্যাদিও গুরুত্বপূর্ণ।
জণ্ডিস প্রতিরোধ / প্রতিষেধক / চিকিৎসা :
আগেই বলা হয়েছে জন্ডিস কোনো রোগ নয়, একটি উপসর্গমাত্র। তাই জণ্ডিসের কোনো ওষুধও নাই। শরীরে জণ্ডিস দেখা দেবার ৪ সপ্তাহের মধ্যে, রক্তের বিলিরুবিন মাত্রা স্বাভাবিক হয়ে গেলে, জন্ডিসের জন্য কোন রকম চিকিৎসার দরকার হয় না। জন্ডিস আক্রান্ত রোগীকে পূর্ণ বিশ্রামে থাকতে হয়। পর্যাপ্ত বিশুদ্ধ পানি, শর্করা ও ভিটামিন সি-যুক্ত খাবার খেতে হয়। ডেক্সট্রোজ, আখের রস, আনারস ইত্যাদি জন্ডিস রোগীর জন্য উপকারী বলে জানা গেছে।
সাধারনতঃ প্যারাসিটামল, অ্যাসপিরিন, ঘুমের ওষুধসহ অন্য কিছু ঔষধ, জণ্ডিস আক্রান্ত ব্যক্তিকে খাওয়ানো উচিত নয়। নিয়মিত মলত্যাগ নিশ্চিত করার জন্য, লঘুপাক খাদ্য বা প্রয়োজনে কারমিনেটিভ এবং ল্যাক্সাটিভ উপাদন, যেমন ভূষি, ল্যাকটুলোজ, ফাইবোলাক্স ইত্যাদি দেওয়া হয়। সাধারণভাবে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকা, জীবাণুমুক্ত খাবার ও পানীয় গ্রহণ করাই জন্ডিসের আক্রমণ থেকে বাঁচার মূল উপায়। খোলা, ময়লাযুক্ত পরিবেশে পরিবেশিত পানীয়, জুস, সরবত ইত্যাদি খাওয়ার ক্ষেত্রে সাবধান হওয়া জরুরী। গুরুতর ক্ষেত্রে রোগীকে রক্ত দেবার প্রয়োজন হয়ে পড়ে।
বিভিন্ন রকম হেপাটাইটিসের ক্ষেত্রে যে প্রতিরোধ ও প্রতিকার ব্যবস্থা নেওয়া হয়, প্রকারান্তরে ঐগুলো হেপাটাইটিসজনিত জণ্ডিসের জন্য প্রযুক্ত। সর্বোপরি ভ্যাকসিন বা টিকাই হেপাটাইটিস থেকে মুক্তির মূল ভরসা।
নিওনেটাল (নবজাতকের) জণ্ডিস-এর মূল চিকিৎসা হলো – Phototherapy
আরও পড়ুন –